নিউজ ডেক্স।
স্কুল জীবনে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী ‘মহেশ’ গল্প সবাই পড়েছে। সেই গল্পে নিজের মামা জমিদার বিনয় কুমার চট্টোপাধ্যায়ের নিষ্ঠুর শাসন ও প্রজাদের ওপর অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেই জমিদার বাড়ির কথা উল্লেখ করেছিলেন সেটি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার কেডিকে ইউনিয়নের কাশিপুর জমিদার বাড়ি বলে কথিত আছে।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত ১৬৪ বছর বসয়ী বাড়িটি এখন অনেকটা ধ্বসের পথে। সংস্কারের অভাবে পুরোনো ভবনের ছাদ ধসে পড়ছে। ইতিমধ্যে বৈঠকখানা, জমিদারের বিচারখানাসহ কয়েকটি ভবন একেবারে ভেঙে গেছে। তবে দুটি ভবনের কয়েকটি কক্ষ কিছুটা ভালো থাকায় সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন হাবিল-কাবিল নামের দুই ভাই এবং তাদের এক চাচি।
জানা গেছে, দেশ ভাগের আগে ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিল এই কাশিপুর। কথিত আছে, ভৈরব নদের পাশ ঘেঁষে হিন্দু জমিদার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা বিনয় কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮৬১ সালের দিকে এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। এই বাড়ি বসে প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতেন বিনয় কুমার। তার অত্যাচার ও নিষ্ঠুর শাসনে অনেক প্রজা এলাকা ছাড়তে। মামার শাসনের নিষ্ঠুরতা দেখে মহেশ গল্প লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে বটগাছ ও কৃষ্ণচূড়া গাছ। এছাড়া বাড়িতে মধ্যে রয়েছে জমিদারের সময়কার কুয়া, দু-একটি খাট, টেবিলসহ কয়েকটি জিনিসপত্রসহ মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলনের বিশেষ মোটর। এই জমিদার বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন বিকেলেই কিছু লোকজন আসেন। তবে ঈদ বা কোনো উৎসবে লোকজনের আগমন বেশি থাকে।
জানা গেছে, হাবিল ও কাবিলের পূর্বপুরুষদের সাথে ভারতে ১ হাজার ২০০ বিঘা জমি বিনিময় করে পরিবার নিয়ে চলে যান বিনয় কুমার মজুমদার। বর্তমানে জমিদার বাড়ির একটি ভবনে পাশাপাশি বসবাস করেন হাবিল ও কাবিল। আর পাশের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় বসবাস করেন তাদের এক চাচি। জমিদারের ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের চাচাও চাচাতো ভাইয়েরা বসবাস করেন কাশিপুরের বিভিন্ন এলাকায়। কাবিলও বাড়ির সামনে রাস্তার অপর দিকে নতুন বাড়ি নির্মাণ শুরু করেছেন।
কাবিল বলেন, আমার বয়স এখন ৫৯। আমার বাপ-দাদারা ভারতে ছিল। দেশ ভাগের সময় জমি বিনিময় করে তারা এখানে চলে আসে। ঘরগুলো ভেঙে গেছে। ছাদ খুলে খুলে পড়ছে। বাড়ির সামনের বৈঠকখানা ছিল। এই পাশে আরও বাড়ি ছিল। সেগুলো সব ভেঙে গেছে। এখানে আমি আর আমার বড় ভাই পাশাপাশি থাকি। আমি যেদিকে থাকি সেদিকে থাকার অবস্থা নেই। তাই সামনে নতুন বাড়ি বানাচ্ছি।
কাবিল আরও বলেন, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে মানুষ বাড়ি দেখতে আছে। গেট সব সময় খোলা থাকে। বাড়ির উঠান থেকে দেখা যায়। তবে আমরা এখানে বসবাস করি। অনেকেই না জানিয়ে ছাদে ওঠে। এই ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে উঠলে যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে কাবিল বলেন, সঠিক ইতিহাস জানি না। তবে লোকমুখে কিছুটা শুনেছি। ওপরের ওই ছাড়ে বসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প লিখতেন।
কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা কাদের বলেন, অনেক পুরাতন বাড়ি। মানুষজন দেখতে আসে। বই-পুস্তকে গল্প আছে শুনেছি। আমরা শুনেছি। সঠিক আমি জানি নে। সঠিক জানি নে, শুনেছি বই-পুস্তকে এই জমিদার বাড়ি আছে।
রকি নামের এক যুবক বলেন, কাশিপুর জমিদার বাড়ি এলাকার মধ্যে একটি জনপ্রিয় স্থান। শুনেছি এটা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। এটি জীবননগরের ঐতিহ্য বহন করে। প্রায় প্রতিদিন অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসেন। যদি এটি সংস্কার করা হয়, তাহলে এটি আরও মানুষ দেখতে আসবে। জীবননগরের পরিচিতি বাড়বে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাড়িটির ইতিহাস নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। বিনয় কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮৬১ সালে বাড়িটি নির্মাণ করেন। আবার ১৯৪৭ সালে সম্পত্তি বিনিময় করে ভারতে চলে যান। তাহলে তিনি জমিদারি করেছেন প্রায় ১০০ বছর। তবে ইতিহাসে তিনি কত বছর বেঁচে ছিলেন সেটি জানা যায়নি। আবার কারও পক্ষে ১০০ বছর ধরে জমিদারি করাও সম্ভব না। আবার ইতিহাস বিনয় কুমারের ভাইয়ের নাম ছাড়া তাদের পূর্ব পুরুষ বা পরবর্তী প্রজন্মের পরিচয়ও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল আমীন বলেন, আমি জীবননগরে যোগদানের পর সেখানে যারা বসবাস করেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা বাড়ির সঠিক ইতিহাস জানাতে পারেনি। বাড়িটির সঠিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন। যদি সঠিক ইতিহাস জানা যায় এবং সেখানে যারা বসবাস করছে এবং এলাকার মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যায়, আমরা সেখানে শরৎচন্দ্রের স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।
